Sunday, August 14, 2011

এতো অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভার নেবে কে?

http://www.mzamin.com/index.php?option=com_content&view=article&id=16814:2011-08-14-13-50-51&catid=36:local&Itemid=68মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন: অস্বাভাবিকভাবেই চলে গেলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও টেলিভিশন সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মিশুক মুনীর। কিছুদিন আগে অস্বাভাবিকভাবে চলে গেলেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী আবিদ। দু’জনের চলে যাওয়া সড়ক পথে, একজনের সমুদ্রে। সমুদ্রের বিশালতায় মুগ্ধ হবার জন্য মানুষ বার বার ছুটে যায় বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে। আগে শীত মওসুম আর ঈদ উৎসবে কক্সবাজারে ঢল নামতো মানুষের সমুদ্রের টানে। এখন বারো মাসই ঢল নামে। সমুদ্রের বিশালতার কাছে কোন সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তাইতো রমজান মাসের আগে পিকনিকে গিয়েছিলেন আবিদ তার কর্মস্থল মাত্রার সঙ্গে। আনন্দ উচ্ছলতাকে পরিপূর্ণ করতে সমুদ্রে নেমেছিলেন। কিন্তু জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারেননি। সমুদ্রের বিশালতায় হারিয়ে গিয়েছিলেন গান গেয়ে সবার মন জয় করা প্রাণবন্ত তরুণ আবিদ। ফিরে এসেছেন নিসপ্রাণ দেহে। সঙ্গে দুই বন্ধু। আবিদের মতো সম্ভাবনার অকাল এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর বেদনায় স্তব্ধ সংস্কৃতি অঙ্গন। জাতি যখন সমুদ্র সৈকতের নিরাপত্তা নিয়ে নানা ভাবনায় বিভোর ঠিক তখনই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও বরেণ্য চিত্রগ্রাহক এটিএন নিউজের সিইও মিশুক মুনীরসহ ৫ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ। শোকে স্তব্ধ পুরো শিল্পাঙ্গন। সড়ক দুর্ঘটনার মরণ ফাঁদ যেন উন্মুখ হয়ে আছে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার জন্য। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের আগে চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাই-এ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন স্কুল ছাত্রের অকাল মৃত্যু হয়। যা সহ্য করার মতো নয়। জাতি পারছে না এতো অস্বাভাবিক মৃত্যু সহ্য করতে। কিন্তু যাদের সহ্য করার কথা এবং যন্ত্রযানকে যারা যন্ত্রদানবে পরিণত করছে তাদের দেখার কেউ নেই। সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ব্যস্ত বড় বড় কাজ নিয়ে। গাজীপুর চৌরাস্তার করুণ দশার জন্য উত্তরাঞ্চলের পরিবহন বন্ধ থাকছে। দুর্ভোগে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। দুর্ঘটনা এড়াতে এবং গাড়ির স্থায়িত্ব রক্ষা করতে মালিকেরা বন্ধ রেখেছেন বাস চালানো। জনগণের ভোগান্তির শেষ নেই। কিন্তু সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই। আজ থেকে প্রায় ১৫/১৬ বছর আগে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন জনপ্রিয় চিত্রতারকা ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। প্রিয়তমা স্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ইলিয়াস কাঞ্চন গড়ে তোলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই দিবস’। প্রায় দশ বছর পর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দিবসটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ গঠন করেছিলেন, সেই উদ্দেশ্য আজও পূরণ হয়নি। ইলিয়াস কাঞ্চন দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে প্রতিটি সরকারের কাছে নিরাপদ সড়কের জন্য যে সকল প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিলেন, বিভিন্ন সভা সমিতি টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে, সেগুলো কোন সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রীই কানে নেননি। এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। প্রতিটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার সময় দেখি গাড়িরচালক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে জনগণের সঙ্গে মিশে যায়। নিরাপদ সড়ক চাই-এর একজন কর্মী হিসেবে আমরা জেলা উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে পদযাত্রা করেছি জনগণকে সচেতন করার জন্য। প্রতি বছরের ২২শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক নিরাপদ সড়ক চাই দিবসের সরকারের কাছে নানা প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি। এর মধ্যে একটি প্রস্তাবনা ছিল বাস ও ট্রাক চালকদেরকে নির্দিষ্ট পোশাক দিতে হবে। যাতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সহজে পালিয়ে যেতে না পারে। সরকার নির্দিষ্ট পোশাক দিয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভার ও সিএনজি চালকদের। অবশ্য প্রাইভেট কার চালকদের বাদ রাখা হয়েছে এই দল থেকে। অথচ যারা সব সময় দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে সেইসব বাস ট্রাক চালকদের জন্য নির্দিষ্ট কোন পোশাক সরকার দিতে পারেনি। ৪৫ জন স্কুল ছাত্রকে হত্যা করে ট্রাকচালক ঠিকই পালিয়ে যায়। যদিও পরে সে ধরা পড়েছে। ধরা পড়ার পর তার কি শাস্তি হয়েছে, ওই ট্রাক মালিকের কি শাস্তি হয়েছে তা কেউ জানেন না। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের বহনকারী মাইক্রোবাসটিকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল বাস চালক। অথচ দুর্ভাগ্য দেশ। একজন বাসযাত্রীও এই নির্মম সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদ করে চালককে আটকাবার চেষ্টা করলেন না। তারাও পালিয়ে গেলেন চালকের সঙ্গে। যে বাস চালক এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে সে কি জানে ওই মাইক্রোবাসটিতে দেশের মূল্যবান সম্পদরা ছিলেন। সে কি জানে তার ভুলে এ দেশের শিল্প সংস্কৃতি জগৎ কাদেরকে হারিয়েছে। সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্তও হবে। কিন্তু কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে কিনা কিংবা ওই বাস চালকের শাস্তি হবে কিনা তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারবেন না। কিন্তু আমরা বলতো পারবো, যা হারিয়েছি তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীররা আর ফিরবেন না আমাদের স্বপ্ন দেখাতে। আবিদও ফিরবেন না তার সুরেলা কণ্ঠের যাদুকে আমাদের মুগ্ধ করতে। সড়কে নিরাপত্তা নেই দীর্ঘ বছর ধরে। এখন সমুদ্রেও নেই। জোয়ার ভাটার সময় শুধু লাল সবুজ পতাকা তুলেই দায়িত্ব শেষ করে কর্তৃপক্ষ। সৈকতে পর্যটকদের সতর্ক করার কোন ব্যবস্থা নেই। কিছুই নেই এখন এই দেশে। সবচেয়ে বড় কথা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। সকালে বাসা থেকে বের হলে রাতে আবার ফিরতে পারবেন কিনা এর নিশ্চয়তা নেই। প্রতিটি সড়ক এখন মৃত্যুফাঁদ। দিনের বেলায় রাজধানীতে ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও ট্রাকের চেয়ে দ্বিগুণ বড় কাভার্ডভ্যান চলছে ঠিকই। রাজধানীর বাসগুলো বেপরোয়া। চাকলরা নিয়ন্ত্রণহীন। অধিকাংশ বাস চালায় হেলপার। এসব দেখার কেউ নেই। তারেক মাসুদও এসব দেখতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষকে নিয়ে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে স্বপ্নের জাল বুনতে। চলচ্চিত্র নিয়ে অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকা তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরেরা বাংলাদেশের সড়ক পথের ভয়াবহতা ভুলেই গিয়েছিলেন। মানুষকে দেখানো স্বপ্ন নিয়ে বিভোর ছিলেন। তারেক মাসুদ আদমসুরাত থেকে রানওয়ে পর্যন্ত প্রতিটি ছবিতে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। মুক্তির গান, অন্তর্যাত্রা, মাটির ময়নার পর কাগজের ফুল বানাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন দুই বছর আগে। সদাহাস্য আর দরাজ কণ্ঠের অধিকারী তারেক মাসুদ যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন, কথা বলার সময় হাসি লেগে থাকতো তার ঠোঁটে। আজ সেই মুখ নেই। সেই হাসি নেই। অস্বাভাবিক মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে সব। এর দায়ভার শিল্পজগৎ নিতে পারছে না। হয়তো পারবে না কোনদিনই। কিন্তু তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর এবং আবিদের হাসি মাখা মুখের চিত্রটা আমাদের সকলের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে ততদিন, যতদিন সরকার সড়ককে নিরাপদ করার উদ্যোগ না নেবে। মালিক চালকদের আন্দোলনের ভয় আর অসুস্থ রাজনীতির যাঁতাকল থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বেই। প্রশ্ন এখন একটাই, এতো সব অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভার নেবে কে?

No comments:

Post a Comment